মেয়ের প্রতি পিতা-মাতার উপদেশ:মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর স্বামীর ঘরে যাওয়ার পূর্ণে পিতামাতা বা অভিভাকগণ সাধারণ কিছু উপদেশ দিয়ে থাকে। মেয়ে এ পর্যন্ত পিতামাতার স্নেহ আদরে পালিত হয়েছে। হঠাৎ করে অন্যের ঘরে যেয়ে হয়তো কিছু অসুবিধায় পড়তে পারে। পিতামাতা তার এত আদরের মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দেয়, যাতে তার কন্যা স্বামীর ঘরে যেয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। তার নিমিত্তে কিছু উপদেশ এখানে প্রদত্ত হল।
১. পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় তোমাকে যার হাতে অর্পণ করলাম, সবসময় তার অনুগত হয়ে চলবে। তার আদেশ উপদেশ সব সময় মেনে চলবে। যথাসাধ্য তার সেবা শশ্রুষা করবে। সে তোমার হামী। তার সুখে তোমার সুখ তার দুঃখে। তোমার দুঃখ এইভাবে তার মন জোগায়ে চলতে চেষ্টা করবা। ২. এখন থেকে আমাদের চেয়ে তোমার স্বামীর বাড়ি নিজের মনে করবে। তার
কারণ, পিতামাতার বাড়ীর নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত তুমি ছিলে। এখন থেকে তোমার স্বামীর বাড়িরই আপন। তোমার স্বামীর পিতামাতা তোমার পিতামাতার সমতুল্য মনে করবে। স্বামীর ভাই বোনদের নিজের ভাই বোনের মত মনে করবে। তারা যেন তোমাকে পর ভাবতে না পারে।
৩. তোমার শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী সবার সাথে খুব নরম ব্যবহার করবে। তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলবে। কেউ যেন বলতে না পারে, কেমন মেয়ে যে আদব কায়দা কিছুই জানে না। এধরনের কথা কেউ বললে তুমি মনে ভীষণ কষ্ট পাবে। কাজেই এধনের কথা যাতে কেউ বলতে না পারে সে দিকে সব সময় খেয়াল রাখবে।
৪.. স্বামী যদি কখনও ভুল করে বসে, তোমার সম্বন্ধে কোন খারাপ ধারণা করে, তবে তুমি তার সাথে তর্ক করিও না। মনে কোন দুঃখ নিও না। তোমার নিজের ভালর জন্য নীরবে সহ্য কররে। পরে স্বামী যখন বুঝতে পারবে তখন সেই তোমার কাছে তার ভুল
স্বীকার করবে। আর যদি সম্ভব হয় তবে স্বামীর মন মেজাজ যখন ঠাণ্ডা থাকে তখন ধীরে ধীরে বুঝাইতে হবে। স্বামী যদি জ্ঞানী হয় তাহলে তোমার বুঝ সে নিবে। ৫. কারও সাথে হিংসা করবে না। হিংসা করা মহাপাপ হিংসা, অহংকার, আল্লাহ পছন্দ করবেন না। হিংসার জন্যে সংসারে শান্তি বিনষ্ট হয়ে যায়। এতে অনেকের সংসার ভেঙ্গে যায়। ননদ, জা এদের সাথে কখনও হিংসা করবে না। এরা যদি তোমাকে ভাল
বলে তবে স্বামী তোমাকে আরও বেশি ভালবাসবে। এবং তোমার শ্বশুর শ্বাশুরী ও তোমাকে ভালবাসবে। ৬. কারও অসাক্ষাতে নিন্দা করবে না। ননদ-দেবর, শ্বশুর-শ্বাশুরীদের বিরুদ্ধে স্বামীর নিকট কখনও নালিশ করবে না। এতে স্বামীর মন তোমার প্রতি হালকা হয়ে যেতে পারে।
৭. স্বামীর আর্থিক অবস্থার যদি তোমার পিতামাতার আর্থিক অবস্থার চেয়ে খারাপ হয় তবুও তুমি স্বামীর বাড়িতে তোমার পিতামাতার আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা বলে গর্ব করবে না। এতে স্বামীর মন তোমার প্রতি বিষিয়ে উঠতে পারে এবং সংসারের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে।
৮. সব সময় স্বামীর ইচ্ছার উপর খেয়াল রাখবে। স্বামী যদি তোমার জন্যে ইচ্ছা করে কোন জিনিস আনে যদিও সেটা তোমার পছন্দ হয় নাই তবু মখু ফুটে স্বামীকে কিছুবলবে না বরং হাসিমুখে তা গ্রহণ করবে। স্বামী যাতে কোনক্রমেই বুঝতে না পারে যে জিনিসটা তোমার পছন্দ হয় নাই।
৯. সব সময় পাক পবিত্র অবস্থায় থাকতে চেষ্টা করবে। পর্দা ইসলামে ফরজ পূর্ণ শরীয়তী পর্দা রক্ষা করে চলবে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কখনও বাড়ি থেকে বের হবে না। কোন আত্মীয় বাড়ি বা কোন প্রতিবেশীর বাড়িও যাবে না। ১০. নামায আল্লাহ পাক মানুষের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। কাজেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। ফযরের নামাযের পর কোরআন তেলাওয়াত করবে। ইসলামী বইপত্র পড়বে। নভেল, নাটক উপন্যাস এই জাতীয় বই পড়বে না। এতে চরিত্রের ভিতর কালো দাগ পড়ে যায়।
১১. লজ্জা হল ঈমানের অর্ধেক। আর এই লজ্জাই হল নারীর অলংকার। যদি তুমি লজ্জাহীনভাবে চলাফেরা কর, কথাবার্তা বল তবে লোকে খারাপ বলবে। লোকে বলবে মেয়েটি লজ্জাহীন। কাজেই সবার সাথে নম্র ও বিনয় সহকারে কথা বলবে।
১২. প্রতিদিন খুব ভোরে বিছানা ত্যাগ করে পরিষ্কার-পরিছন্ন হয়ে ফযরের নামায পড়বে এবং স্বামীকে পড়তে বলবে। তুমি যদি স্বামীকে নামায পড়তে বল তাহলে আল্লাহ তোমার উপর সন্তুষ্ট হবেন। স্বামীর আগে কখন খানা খাবে না। স্বামী যদি বিদেশে থাকে ঝ বাড়ির বাহিরে থাকে তবে তার কথা আলাদা।
১৩. স্বামীর কাপড় চোপড় পরিষ্কার করে খুব সুন্দর করে আলনায় সাজাইয়া রাখবে। সেই সাথে তোমার কাপড় চোপড়ও পরিষ্কার পরিছন্ন করে সাজাইয়া রাখবে। লোকে দেখে যেন বলে মেয়েটির রুচিবোধ আছে।
জামাতার প্রতি শ্বশুরের উপদেশ: বিবাহ কার্য সম্পাদন হওয়ার পর জামাতাকে বাড়ির ভিতর এনে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। সরবত বা দুধ খাওয়ানোর পরে জামাতাকে কিছু উপদেশ দিতে হয় তাই খুব সংক্ষিপ্তাকারে এখানে উল্লেখ করলাম।
মেয়ের পিতা নিজের কন্যার হাত এবং জামাতার হাত একত্র করে জামাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আল্লাহ পাকের উপর ভরসা করে আমার কলিজার টুকরা নয়নের মণিকে তোমার হাতে অর্পণ করলাম। এখন হতে তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব তোমার উপর খুবই অর্পণ করলাম। তার মান ইজ্জত সবই তোমার হাতে। সংসারের ক্ষেত্রে আমার মেয়ে খুবই অনভিজ্ঞ কাজেই তার ভুলত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তুমি তোমার নিজ গুণে তার ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে এবং তার যে সব ভুলত্রুটি দেখতে পাবে তা সংশোধন করে দিবে।
সংসার খুবই কঠিন স্থান। এখানে চলার পথে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে চলতে হবে যাতে চলার পথে কোন অসুবিধা না হয়। সব অবস্থায় আল্লাহ পাকের উপর নির্ভর করে চলবে।
সবসময় আল্লাহর হুকুম পালন করবে। নামায, রোযা, যাকাত সম্ভব হলে হজ্ব সম্পাদন করবে। তোমার স্ত্রীকে সব সময় পর্দা-পুষিদায় রাখতে চেষ্টা করবে। তোমার পিতামতার খেদমত করতে ভুল করিও না। কারণ পিতামাতাই হল সন্তানের বেহশত দোযখ। পিতামাতা সন্তানের প্রতি খুশী থাকলে আল্লাহ পাক খুশী থাকেন। আর আল্লাহ পাক খুশী থাকলে তোমাদের সংসারে বেহেশতী সুখ নেমে আসবে। তোমাদের মধুময় । দাম্পত্য জীবনের জন্য আল্লাহ পাকের নিকট দোয়া করছি যে, তিনি যেন তোমাদেরকে দীর্ঘজীবি করেন।
স্বামীর বাড়ি নতুন বউ আগমন করলে স্বামীর মাতা, বোন বা অন্যান্য নিক-টাত্মীয় মা হলাগণ এগিয়ে এসে নতুন বউকে হাত ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে যায়। সবাই নববধূকে মন ভরে দেখতে থাকে এবং প্রাণভরে দোয়া করতে থাকে।
নববধূ বিস্মিল্লাহ বলে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করবে। প্রবেশ করেই সবাইকে সালাম দিবে। যারা মুরব্বী শ্রেণীর মহিলা তাদের কদমবুছি করবে। অনেক জায়গায় দেখা যায় নববধূ এবং তার স্বামীকে এক যায়গায় বসাইয়া দুধ পান করতে দেয়।
প্রথমে নববধূকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে আল্লাহ এবং রাসূলের হুকুমের, কোন বরখেলাপ না হয়। স্বামীর ঘরে প্রবেশ করেই আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করবে। তারপর শ্বশুর বাড়ির কাজ কর্ম আরম্ভ হল। সব সময় নববধূকে খেয়াল রাখতে হবে বাড়ির সবাইকে কিভাবে খুশী রাখা যায়। আদব-কায়দা, বিনয়-নম্রতা, ভক্তি-শ্রদ্ধার দ্বারা শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, ননদ-দেবর ও অন্যান্য আত্মীয়দের মন খুশী করতে হবে। পিতার বাড়ি হতে আসার সময় পিতামাতা বা অন্যান্য মুরব্বীগণ যা উপদেশ দিয়েছে তা সবসময় মনে রাখতে হবে। এবং সেইমত চলতে হবে। নববধূ কখনো মুখ ভার করে বসে থাকবে না। সব সময় মুখে হাসিখুশি রাখতে হবে। প্রথমে শ্বশুর বাড়ির চালচলনের দিকে খেয়াল করতে হবে। এবং সেগুলো আয়ত্ব করতে হবে এবং সেই অনুসারে চলাফেরা করার চেষ্টা করবে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের মধ্যে নতুন বউ দেখার একটা হিরিক পড়ে যায়।
সবাই আসে নববধূকে দেখার জন্য। যখন পাড়াপ্রতিবেশী নববধূকে দেখার জন্য আসবে তখন হাসিমুখে সবাইকে সালম জানাইতে হবে। তাহাদের সাথে দু'চারটি কথাবার্তা বলতে হবে। ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক যাদের সাথে দেখা দেয়া জায়েয নাই তাদের সাথে দেখা করবে না। তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করবে।
নববধূর জন্য স্বামীর ঘর প্রথম প্রথম নতুন বলে মনে হইলেও তাকে সব সময় মনে রাখতে হবে যে, শ্বশুর বাড়িই তার নিজের বাড়ি। পিতার বাড়ি ছিল অস্থায়ী সময়ের জন্য। পিতার বাড়ি যত বেশি সম্পদ থাকুক না কেন স্বামীর বাড়িতে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
বাসর ঘরে প্রথম রাত্রি যাপন: বাসরঘর বলতে প্রত্যেকের মনেই একটা আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। কারণ কেউ হয়তো বাসরঘর যাপন করেছে। আবার কেউ হয়তো বাসর সাজাবে বলে চিন্তা-ভাবনা করছে। কেউ হয়তো কল্পনার বাসরগৃহে কল্পনার নববধূর কথা চিন্তা করছে। বাসরঘর মানুষের জীবনের গতিকে নতুন দিকে পরিচালিত করে দেয়। এই বাসরঘরের মাধ্যমেই দুটি মানব-মানবীর মনের নববসন্তের উন্মেষ ঘটে।
বাসরঘর প্রত্যেক মানুষের জীবনে আসে। কাজেই এই বাসরঘর এমন একটি ঘর হতে হবে যেখানে দ্বিতীয় কোন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকবে না। ঘরকে সুন্দর করে পরিষ্কার করে নিতে হয়। খাটে সুন্দর বিছানা পেতে তাতে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি ফুল দিয়ে সুবাসিত করতে হয়। এ ছাড়াও অন্যান্য সুগন্ধযুক্ত আতর গোলাপ ইত্যাদি ঘর ময় ছিটাইয়া দিতে হয়। অন্যান্য বৃঙিন কাগজ দিয়ে ঘরের চারদিকে ঝালর দিয়ে সুন্দর মনোরম করতে হয়। যেন বেহেশতী আমেজ পরিপূর্ণরূপে অনুভূত হতে থাকে।
নববধূকে সুন্দর রূপে সাজিয়ে বাসরঘরে আসতে হয়। তারপর তাকে খাটের উপর বসিয়ে দেওয়া হয়। রাত ১০টা ১১টার দিকে বরকে ও অনুরূপ সাজিয়ে নববধূর কাছে আনা হয়। সযাই ঘর থেকে চলে যায়। শুধু বর-কনে ঐ ঘরে থাকে। নববধু স্বামীকে দেখে সালাম দেয়। সালামের উত্তর দিয়ে সর নববধুর কাছে খাটে যেয়ে বসে। দুইজন দুইজনের অমিয় সুধা পান করতে থাকে। কারও যেন মন ভরে না এমন অবস্থা হয়। কত কথা স্বামী-স্ত্রী মিলে বলবে কিন্তু কথা বলতে যেয়ে উভয়েই কম্পিত হতে থাকে। তার কারণ প্রথম দিন সবারই এই ধরনের অবস্থা হয়।
বাসররাত নবদম্পতিদের চরম আনন্দের দিন। এই দিনের অপেক্ষা এতটা দিন অপেক্ষা করেছিল উভয়েই। অবশেষে সেই শুভ দিনের আগমন ঘটল। নিরবতা, জড়তা ভঙ্গ করে বলে, প্রাণেশ্বরী। আজ আমাদের জীবনের পরম আনন্দের দিন। সত্যি করে বলতো আমাকে তোমার ভাল লেগেছে কি না? নববধূ উত্তর দেয় না শুধু চোখের ভাষায় বোঝা যায় যে নববধূ বলছে তাকে খুব পছন্দ হয়েছে।
উভয়ে দুই রাকআত নফল নামায পড়ে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়লো। স্বামী-স্ত্রী একান্ত মিলিতভাবে শুয়ে রইল। এমন ভাবতে লাগলো যে এই পৃথিবীতে তাদের মত ভাগ্যবান ব্যক্তি আর কে আছে। আর এত আনন্দই বা কে পাইতেছে। মোয়াজ্জিন ফযর নামাযের আযান দিল। তাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। দু'জনে উঠে গোসল করে পাক পবিত্র হয়ে ফযর নামায পড়ে ঘরে বসে রইল। পরে ভাবীরা এসে তাদেরকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এল। তখন তাদের দ্বিতীয় দিন আরম্ভ হয়ে গেল।
Post a Comment
0Comments